Saturday, April 13, 2019

হালো ইফেক্ট (The Halo Effect in Bangla)

The Halo Effect

হালো ইফেক্ট

 

হালো ইফেক্ট (Halo Effect)এর দ্বারা আমরা প্রত্যেকেই প্রভাবিত হই,হচ্ছি। কিন্তু এই হালো ইফেক্ট (Halo Effect)টি কি? কেন ই বা হালো ইফেক্ট (Halo Effect) হয়?
কিভাবে আমাদের হালো ইফেক্ট প্রভাবিত করে? আজ আলোচনা হবে এসব নিয়েই !

আপনার কি কখনো কাউকে দেখে মনে হয়েছে যে, “লোকটা খারাপ”? বা “লোকটার নজর ভাল না”? বা কখনো কাউকে কোন কারন ছাড়াই অসহ্য মনে হয়েছে? কারন ছাড়াই কাউকে ভাল, ভদ্র মনে হয়েছে?

তাহলে, আপনিও বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের মত হালো ইফেক্ট (Halo Effect) প্রত্যক্ষ করেছেন!

হালো ইফেক্ট কি?

হালো ইফেক্ট (Halo Effect) বুঝানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হল একটি ইংরেজী বাক্য দিয়ে বলা। সেটি হল, “Judging a book by its cover”. আমরা যে প্রবাদ টার সাথে পরিচিত সেটি হল, “Don't judge a book by its cover”. অর্থাৎ, বাহিরের আবরণের উপর কোন কিছুকে যাচাই করা উচিত নয়। কিন্তু প্রতিনিয়ত সচেতন বা অবচেতন মনে আমরা এ কাজ টি করেই যাই।

হালো ইফেক্ট (Halo Effect) মূলত হল, কোন ব্যাক্তিকে তার স্বরূপ (Appearance) বা ব্যাক্তিটি দেখতে কেমন, তা দিয়ে যাচাই করা। অর্থাৎ, কারো সম্পর্কে না জেনে বা বুঝে তার সম্পর্কে একটি মতামত দিয়ে ফেলা/ তৈরী করে ফেলা। অন্যভাবে বলা যায় এটি এক ধরনের যুক্তিহীন ধারনা (cognitive bias) কোন ব্যক্তি সম্পর্কে।

হালো ইফেক্ট এর কারন

হালো ইফেক্ট (Halo Effect) এর কারন হল কোন ব্যক্তির চেহারা বা তার নিজেকে উপস্থাপন করার উপায় (Appearance) আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। অন্য সব বিষয় অই ব্যক্তি সম্পর্কে প্রাথমিক মতামত তৈরীতে গৌণ ভূমিকা রাখ। আমাদের মনস্তত্ত্ব (Phycology) অনুসারে মানুষের চেহারা বা চলাফেরা (Appearance) আমাদের সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সচরাচর সুশ্রী, সুন্দর পোষাক পরিহিত ব্যক্তিদের আমরা বুদ্ধিমান, ভদ্র, আকর্ষণীয় ভাবি। একইভাবে, অপেক্ষাকৃত কম সুশ্রী, সাধারন পোষাক পরিহিত মানুষদের আমরা একই ভাবে বুদ্ধিমান বা আকর্ষণীয় বোধ করি না। আরো বলা যায়, যাদের আমাদের দেখে ভাল বা আকর্ষণীয় মনে হয়, আমরা ভেবে নেই যে মানুষটি সামাজিক বা মিশুক হবে। যদিও ঐ ব্যক্তির সাথে আমাদের পরিচয় হয় নি। 

আর এ বিষয়গুলো যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে। ছোটবেলায় আমরা যে গল্প শুনতাম সব গুলোতেই রাজা বা নায়কদের সুশ্রী, আকর্ষণীয় হিসেবে উপস্থাপন করা হত। একই ভাবে ভিলেন বা দুশ্চরিত্রগুলোকে কুশ্রী হিসেবে উপস্থাপন করা হত। এভাবেই যুগ যুগ ধরে আমাদের মনে অবচেতন ভাবে ধারনা তৈরী হয়েছে সুশ্রী ও কুশ্রী মানুষ সম্পর্কে।

হালো ইফেক্ট এর ইতিহাস

হালো ইফেক্ট (Halo Effect) সর্বপ্রথম এডওয়ার্ড থ্রন্ডাইক (Edward Thorndike) ১৯২০ সালে প্রদান করেন। পেশায় তিনি একজন সাইকোলজিস্ট (মনস্তত্ত্বিক)। তিনি সে সময় ২ জন অফিসারকে তাদের সৈন্যদের যাচাই করতে বলেন। সৈন্যদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ভাবে যাচাই করতে বলা হয়। সেই সাথে শর্ত ছিল যে সৈন্যদের সাথে কথা না বলে যাচাই করতে হবে। 

ফল পাওয়া যায় যে, যেসব সৈন্য লম্বা এবং সুশ্রী ছিল তাদের বুদ্ধিমান, চরিত্রবান ও ভাল দলপতি হিসেবে মূল্যয়ন করা হয়েছে। অর্থাৎ, শুধু আপনি দেখতে কেমন, বা মানুষের কাছে আপনি কিভাবে উপস্থাপিত হচ্ছেন তার উপর ই মানুষ অনেক কিছু ভেবে নেয়। 
Halo Effect, Halo Effect in Bangla
Halo Effect


হালো ইফেক্ট এর ব্যবহার

হালো ইফেক্ট (Halo Effect) এর অন্যতম জনপ্রিয় ব্যবহার হল রাজনীতি তে। ছবি, বিলবোর্ড এ নেতাদের হাসোজ্জ্বল ছবি আমাদের মাঝে তাদের দৃঢ় নেতৃত্বের বোধ জাগ্রত করে। এছাড়া বিভিন্ন বিজ্ঞাপন বা সিনেমায় অভিনয়শিল্পী বা মডেলদের বিভিন্ন কাজ ও সেই পন্য সম্পর্কে ইতিবাচক ধারনা উদ্রেক করে।

হালো ইফেক্ট (Halo Effect) এর অনেক খারাপ দিক ও রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ অন্য ব্যক্তি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারনা পোষণ করে ফেলে কোন কারন ছাড়াই। এছাড়া এই মনস্তত্ত্ব ব্যবহার করেই ঠগ,বাটপার রা মানুষকে প্রভাবিত করে তাদের সাথে প্রতারনা করে থাকে।

হালো ইফেক্ট এর প্রভাব

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, শিক্ষকেরা ছাত্রদের দেখেই তাদের সম্পর্কে একটি ধারনা করে ফেলেন। ছাত্ররাও শিক্ষকদের পোষাক, চালচলন দিয়ে শিক্ষক দের যাচাই করে। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকদের এই ধারনা ছাত্রদের পরীক্ষার ফলেও কিছুটা প্রভাব ফেলে। গবেষণায় এটাও দেখা গেছে যে আসামীর চেহারা, ব্যবহার (Appearance) বিচারকের বিচারের উপর ও প্রভাব ফেলে নানা ভাবে!!

Halo Effect, Halo Effect in bangla
Halo Effect


এই হালো ইফেক্ট (Halo Effect) অত্যন্ত প্রভাবশালী আমাদের জীবনে। ইংরেজীতে একটি প্রবাদ আছে, “First impression is the last impression”- অর্থাৎ প্রথম সাক্ষাতেই যদি আমরা নিজেদের ভাল হিসেবে উপস্থাপন না করতে পারি, তাহলে পরবর্তীতে সে ধারনা পরিবর্তন করা অনেক কষ্টসাধ্য। জীবনে প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই এই হালো ইফেক্টের প্রভাব দেখা যায়। প্রেম-ভালবাসায়, কোন পন্য কিনার সময়, কোন খাবার খাওয়ার সময় ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই!

হালো ইফেক্ট (Halo Effect) এর আরেকটি উদাহরন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যখন কোন পরিদর্শক কারো কাজ পরিদর্শন করে, তখন এই হালো ইফেক্ট (Halo Effect) অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে। ধরুন, আপনি সেই কোম্পানির উন্নতিতে অনেক অবদান রেখেছেন। কিন্তু সেই পরিদর্শনের দিন কোন কারনে আপনি সেই কর্মনিষ্ঠা দেখাতে পারেননি; পরিদর্শকের আপনাকে কর্মনিষ্ঠ মনে হয় নি। অথচ অন্য কোন ব্যক্তিকে হয়ত সেই পরিদর্শকের কর্মনিষ্ঠ মনে হয়েছে। সে ক্ষেত্রে প্রমোশন বা পদোন্নতি আপনি পাবেন না। সেই আপাতভাবে মনে হওয়া কর্মনিষ্ঠ ব্যক্তিই পদোন্নতি পাবেন। নির্মম হলে এটিই সত্য।
একই কথা প্রযোজ্য নতুন চাকরি সন্ধানরত মানুষদের ক্ষেত্রে। হাজার হাজার চাকরি দরখাস্তের মধ্যে আপনার দরখাস্ত যদি আপনাকে বাকিদের চেয়ে ভাল বা বুদ্ধিমান হিসেবে না উপস্থাপন করতে পারে, তাহলে সেই চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। সমান যোগ্যতাসম্পন্ন একাধিক ব্যক্তির মধ্যে একজনকে বাছাই করার ক্ষেত্রেও এই হালো ইফেক্ট (Halo Effect) কাজ করে।

বিভিন্ন গবেষণায় আরো জানা যায়, এই হালো ইফেক্ট (Halo Effect) শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই কাজ করে না। বিভিন্ন ব্র‍্যান্ড বা কোম্পানির ক্ষেত্রেও কাজ করে। যেমন আমরা বিভিন্ন সময় কোন খাবারের দোকানের ডেকোরেশন বা সাজ সজ্জা দেখেই চলে যাই সেখানে। অনেক খাবার শুধু দেখতে আকর্ষণীয় দেখেই কিনে খাই। অনেক জুতা, ব্যাগ, টি-শার্ট কিনি শুধুমাত্র তা কোন বিশেষ ব্যান্ডের বলে। অনেক ক্ষেত্রে নানান পন্য ক্রয় করি শুধুমাত্র আমাদের প্রিয় ব্যক্তিত্ব সে পন্যের পন্যদূত বলে। এর কারন হল সেই হালো ইফেক্ট (Halo Effect)। আমরা ভাবি যে সেই অভিনেতা পন্যটির প্রচার করছে তাই পন্যটি ভাল ই হবে। সেই ছবি বা ব্র‍্যান্ড ইমেজ যা সেই কোম্পানিটি তৈরি করেছে। আমরা পারতপক্ষে সেই পন্যের জন্য মূল্য প্রদান করছি না; সেই ব্র‍্যান্ডের নাম বা ছবির জন্য করছি। 

Halo effect, Halo Effect in Bangla
Halo Effect

 এখন আমাদের করণী কি? আমাদের জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিজেকে উপস্থাপন করতে হয়। তাই নিজেকে সকলের কাছে আকর্ষণীয় ও বন্ধুসুলভ ভাবে উপস্থাপন করতে হবে। তাহলেই আমরা সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করতে পারব। চাকরি/ ব্যবসা প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিজেকে যোগ্য, সেরা ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে। 

আরো মাথায় রাখতে হবে যে কাউকে তার বাহ্যিক যোগ্যতায় বিবেচনা করা যাবে না। নিজের সহকর্মী বা কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বদা কাজের যোগ্যতা কে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কারন যোগ্যতর ব্যক্তিরাই সর্বোচ্চ অবদান রাখতে পারে। কারন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে সাধারন ভাবে থাকা (casual) ব্যক্তিরা অধিক কর্মঠ ও যোগ্যতর হয়। তারা সকল ক্ষেত্রে ভাল ফল করে থাকে সচরাচর। এর কারন হল এসকল ব্যক্তিদের তাদের যে তথাকথিত বাহ্যিক অযোগ্যতা অতিক্রম করতে হয় জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই। এ কারনেই তাদের ভাল কর্মযোগ্যতা দেখা যায়। 

মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যয়ন করায় শ্রেয়। একই ভাবে পন্যকে পন্য হিসেবেই মূল্যয়ন করা উচিত। কোন পন্য ক্রয়ের আগে অন্যদের মতামত (review) নেয়া উচিত। মানুষকে তাদের কর্মযোগ্যতা দিয়ে যাচাই করা উচিত। কাউকে তাদের ধর্ম, বর্ণ, চেহারা ইত্যাদি দিয়ে যাচাই করা উচিত নয়।
মানুষ মানেই সেরা জীব তখন ই সম্ভব যখন আমরা নিজেদের ইন্দ্রিয়কে সঠিক ভাবে কাজে লাগাতে পারব। এই হালো ইফেক্ট (Halo Effect) অনেক ক্ষেত্রে ঠিক ভাবে কাজ করলেও সর্বদা যুক্তি দিয়ে চিন্তা করা বা যাচাই করাই শ্রেয়।